জেন-জি এবং একটি বিপ্লব।

4 min read

পিউ রিসার্চ সেন্টার এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি জেনারেশন জেড বা জেন-জিদের ব্যাপারে যে গবেষণা করছে তার কিছু সহজিয়া সারমর্ম হলো এরা বহুমাত্রিক ধারণা ও সমস্যা সমাধানের উপায়কে স্বাগত জানায়; এরা সমাজ, মূল্যবোধ, ও পরিবেশ রক্ষার ব্যপারে অত্যন্ত সচেতন; ডিজিটাল দুনিয়ার সবকিছু এদের নখরদর্পনে; এবং বুড়োদের মাধ্যমে তৈরি সামাজিক ও রাষ্ট্রিক কাঠামোকে এরা অন্ধের মতো মেনে নেয় না। আবার এসব গবেষণা এও বলছে যে এই জেনারেশন এর মধ্যে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা করার প্রবণতা আছে যেটা কিনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইন্টারনেটের কারণে তীব্র হয়। সমস্যা হচ্ছে এইসব গবেষনায় দক্ষিণ এশীয় জেন-জিদের ব্যপারে তেমন কিছু বলা নেই। গত কয়েকদিন ধরে যতগুলো নর্থ আমেরিকান সেমিনার কনফারেন্সে যোগ দিচ্ছি, তার প্রায় প্রত্যেকটাতেই আমাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে বাংলাদেশের জেন-জি অভ্যুত্থানের পিছনে এই প্রজন্মের এত শক্তি ও কর্মক্ষমতার রহস্য কী। কারণ এতদিন পর্যন্ত গবেষকরা জেন জিদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কে কর্মসাধনের পরিপন্থী হিসেবে দেখেছেন। বাংলাদেশের এই জেনারেশানের ডাইরেক্ট-অ্যাকশন এরা চিন্তাও করেন নাই। 


আমার উত্তর একটাই। পারিবারিক গভীর সম্পর্ক, গোষ্ঠীর একাত্মবোধ, ও ধর্মীয় অনুভূতির মিশ্রণ এই প্রজন্মে যেই শক্তি যোগায়, সেটা নর্থ আমেরিকান তীব্র ব্যক্তিসাতন্ত্রে আক্রান্ত সমাজে অসম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেতাঙ্গ কানাডীয় জেন- জিদের পড়াতে গিয়ে বুঝতে পারি বাংলাদেশের জেন-জিদের মানসিক সক্ষমতা এদের থেকে বেশি। ইন্টারনেটের যুগে প্রাপ্ত পশ্চিমা যুক্তিবাদ এবং আমাদের দেশীয় সামাজিক সম্পর্কের শক্তিতে প্রাপ্ত মানসিক জোড় জেন-জিদের জেন-এক্স এবং মিলেনিয়ালদের থেকে অনেক বেশি পরিশুদ্ধ চিন্তুক ও কর্মকেন্দ্রিক করেছে। 


সারা পৃথিবীতে সব বাংলাদেশির মধ্যে এখন দুটো অনুভূতির মিশ্রণ, তীব্র ইতিবাচক আশা আর প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা। টেলিভিশন, প্রিন্ট মিডিয়া, এবং ইন্টারনেট এ যা আসছে আমরা তা গোগ্রাসে খাচ্ছি। আশা ও উদ্বেগের হিসেব নিকেশের সাথে আমরা খবরের সামন্তরিকরণ করছি। এর নির্ণয় একটাই: অশেষ ধৈর্য্য, সহনশীলতা, ও সহিষ্ণুতা। ফরাসি বিপ্লব, হাইতি বিপ্লব, কিউবান বিপ্লব এর সময়গুলোর আগে ও পরে অসংখ্য সংঘর্ষ ও প্রাণনাশের উদাহরণ বিদ্যমান। বাংলাদেশ মেরামতের কাজে এই জেন-জি বিপ্লবে একইভাবে অনেকে শহীদ হয়েছেন। এই মেরামত যতদিন চলবে ছোটখাটো সংঘর্ষ চলতেই থাকবে। সেসব নিয়ে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ইতিবাচক ও নেতিবাচক মন্তব্য হবে, গুজব ছড়াবে, অভিনব শৈল্পিক প্রকাশ ঘটবে, এটাই স্বাভাবিক। দেশ মেরামতের জন্যে এইগুলো জরুরি। 


দার্শনিক প্লেটো তার “রিপাবলিক” লেখাতে, সক্রেটিসের “মহৎ মিথ্যার” প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, সমাজের মানুষকে একত্রিত করার জন্য কিছু মহৎ মিথ্যার প্রয়োজনীয়তা আছে। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে বিশ শতক পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ কিছু বিখ্যাত নেতাকে ঘিরে মহত্ত্বের মিথ তৈরি করে সামাজিক ভারসাম্য এবং যুদ্ধের কৌশলকে বৈধ করার জন্য। সমস্যা হচ্ছে এই কৌশলে অনেক কুচক্রী হিরো বনে যায়। যেমন উইনস্টন চার্চিল ব্রিটিশ হিরো হিসেবে খ্যাত কিন্তু এই বেটা বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ আর প্রচুর মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী যা একেবারেই এড়িয়ে যাওয়া হয়। ব্যাপার হচ্ছে মহত্ত্বের মিথ ব্যক্তিপূজার সূত্রপাত করে। বাংলাদেশে মহত্ত্বের মিথ এবং ব্যক্তিপূজার প্রবণতা শতবছর ধরে স্বাভাবিক। একুশ শতকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে ব্যক্তিপূজার প্রবণতা অনেক দেশেই কমেছে। কানাডার রাষ্ট্রীয়ভাবে সুপ্রসিদ্ধ এবং এই দেশের জনক হিসেবে খ্যাত জন মেকদোনালড এর ভাস্কর্য নামিয়ে নেয়া হয় কারণ তিনি এই দেশের আদিবাসীদের অত্যাচার সহ আরও অনেক কুকর্ম করেছেন। 


বাংলাদেশেও ব্যক্তিপূজা প্রাতিষ্ঠানিক এবং তৃনমূল পর্যায়ে চলে গেছে। জেন-জি ইন্টারনেটে ব্যক্তিপূজাকে অনেকদিন ধরেই প্রশ্ন করছিল এখন সেটাকে একেবারে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। Celebrate the cause and purpose, not the person, এই বোধ এখন অনেকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। ভেবে দেখুন, আমাদের আত্মিক, শৈল্পিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও বস্তগত উৎপাদনশীলতার পেছনে আমরা কত কম সময় দিয়েছি কারণ ব্যক্তির তোষণক্রিয়াতে আমাদের অনেক সময় চলে গেছে। এখনও অনেক প্রধান যোগাযোগ মাধ্যমগুলো নতুনদের তোষণ করছেন। অনেকদিনের অভ্যাস যেতে সময় লাগে। 


তবে এইটুকু বলতে চাই যে আমাদের আবেগের প্রবলতার সাথে যুক্তিবাদের ভারসাম্য থাকা কাম্য। ইউরোপ আর কানাডাতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ আর সংস্কৃতি তত্ত্ব আর সাহিত্য পড়িয়ে বুঝেছি পৃথিবীর কোন দেশ চায়না এইদেশের উন্নতি হোক। এই দেশ দুর্নীতিপরায়ণ থাকলে সব দেশের লাভ। তাই এই জেন-জি বিপ্লব সবাইকে তাক লাগিয়েছে। আমাদের জেন-জি বিপ্লব অনেক দেশের গবেষণার বিষয় হবে। এই বিপ্লব কোন অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিবে নিকট ভবিষ্যতে, সেটাই সবাই দেখতে চাচ্ছে। 


আমার অতি কম জ্ঞান থেকে যা বুঝি, এই সময় দুদক এবং টিআইবি কে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়া আর শক্তিশালী করা জরুরী। 


তবে আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হল বিশ্ববিদ্যালয়। যেহেতু বাংলাদেশে বেসরকারি ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকদিন পড়িয়েছি, সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, জেন-জি প্রজন্ম যেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আরও ধৈর্যশীল হয়। স্বায়ত্তশাসন ও তিয়াত্তুর এর অ্যাক্ট এর নেতিবাচক দিকগুলো অনেক সংবেদনশীল, এই নেতিবাচক দিকগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরানো অনেক জটিল। কোন কারণে পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকুক এটা একেবারেই কাম্য নয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিপূর্ণ শিক্ষার পথ ঠিক হলে আমাদের অর্থনীতি রাতারাতি পরিবর্তন হতে পারে। আমরা পাঁচ বছরের ডিগ্রি আট বছরে শেষ করেছিলাম, এইরকম নিয়তি আর যেন কারও না হয়। 


বিদেশে বসে আরামে থেকে দেশে মাঠে না নেমে দেশের ব্যাপারে চর্বিত চর্বণ লেখার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছি কারণ জেন-জি দের এই বিপ্লব অপ্রত্যাশিত ও অতুলনীয়। অভ্র তে ভালো কুশলী নই, তাই বানান ভুলের জন্য লজ্জিত। 


বাংলাদেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠার পর, দেশে থাকুন বা বিদেশে থাকুন কিছু কুশিক্ষাকে মাথা থেকে সরানো জরুরী কিন্তু সরানো কঠিন। দেশে থাকুন বা বিদেশে থাকুন এই কুশিক্ষা আমাদের অনেক কষ্টের কারণ। দেশ কে detox করার আর আমাদের মানসিকতা detox করার জন্য এই কুশিক্ষা তাড়ানোর তরিকায় থাকতে থাকতেই মুক্তি। 


“তরিকা সবারই এক, ভাঙ্গা নৌকা বাইতে হইব।“ 


জয় হোক সবার!


Author: Golam Rabbani Shihab 

Faculty member at the School of Creative Industries at Toronto Metropolitan University

Post a Comment